নিজস্ব প্রতিবেদক | রাজবাড়ী
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫) জুমার নামাজের পর তৌহিদি জনতার বিক্ষোভ ভয়াবহ সহিংসতায় রূপ নেয়। এ সময় আলোচিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব পীর নুরুল হক নুরাল পাগলার দরবার শরিফ ও বাড়িতে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা দরবারে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। চরম ধৃষ্টতা দেখিয়ে কবর থেকে তাঁর মরদেহ তুলে এনে মহাসড়কের পাশে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় এক যুবক নিহত হয়েছেন এবং অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন।
ঘটনাপটভূমি:নুরাল পাগলা নামে পরিচিত নুরুল হক ছিলেন স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজেকে ‘ইমাম মাহাদী’ দাবিও করেছিলেন। গত ২৩ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অনুসারীরা প্রচলিত ইসলামী বিধান অমান্য করে অস্বাভাবিকভাবে মাটি থেকে উঁচুতে কবর নির্মাণ করে সেখানে দাফন করেন।
এ ঘটনায় এলাকাবাসী ও বিভিন্ন ইসলামপন্থী সংগঠন ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং কবর সমান করার দাবি তোলে। তারা অভিযোগ করে, এটি শরিয়তবিরোধী কাজ। কয়েক দিন ধরে উত্তেজনা চলতে থাকলেও দাবি পূরণ না হওয়ায় শুক্রবার জুমার পর আন্দোলনকারীরা পূর্ব ঘোষণামতো কর্মসূচি নেয়।
হামলা ও সহিংসতা:জুমার নামাজ শেষে হাজারো মানুষ শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে মিছিল নিয়ে দরবারের দিকে যায়। সেখানে ঢুকে তারা দরবার শরিফ ও বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। পরে পুরো এলাকাজুড়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যখন একদল মানুষ দরবার চত্বর থেকে নুরাল পাগলার মরদেহ কবর ভেঙে বের করে আনে। পরে সেটি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পদ্মার মোড়ে এনে প্রকাশ্যে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে।
হতাহতের ঘটনা:
হামলা-সংঘর্ষে রাসেল মোল্লা (২৮) নামে এক যুবক নিহত হন। তিনি দেবগ্রাম ইউনিয়নের আজাদ মোল্লার ছেলে। আহত হয়েছেন পুলিশসহ অন্তত ৫০ জন। তাদের মধ্যে অনেকেই গুরুতর আহত অবস্থায় রাজবাড়ী ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা:
ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ, র্যাব এবং সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। তবে শুরুতে উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হয়। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থানের ফলে সহিংসতা কিছুটা কমে আসে।
ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট ঘণ্টাব্যাপী প্রচেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
গোয়ালন্দ থানার ওসি জানিয়েছেন, হামলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।
স্থানীয় প্রতিক্রিয়া:ঘটনার পর পুরো গোয়ালন্দ শহরে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে, রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষ বলছেন, একটি ভিন্নধর্মী কবরকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া দ্বন্দ্বের জেরে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটবে—তা কেউ ভাবতে পারেনি।
নুরাল পাগলার অনুসারীরা শোক প্রকাশ করে বলেছেন, “আমাদের প্রিয় পীরের মরদেহকে এভাবে অসম্মান করার ঘটনা হৃদয়বিদারক। এটি আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে মারাত্মক আঘাত।”
অন্যদিকে ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো বলছে, “শরিয়ত পরিপন্থী কাজ কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না। আজকের ঘটনা তারই বহিঃপ্রকাশ।”
পরিস্থিতি:এখনো এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টহল জোরদার করেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন এবং দোষীদের দ্রুত বিচারের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
সারসংক্ষেপ:গোয়ালন্দের এই ঘটনা শুধু একটি স্থানীয় বিরোধ নয়, বরং ধর্মীয় আবেগ, উগ্রতা এবং সামাজিক সম্প্রীতির ভাঙনের এক করুণ চিত্র। কবর প্রথা নিয়ে বিতর্কের সূত্র ধরে শুরু হওয়া উত্তেজনা এখন রূপ নিয়েছে প্রাণহানি ও সামাজিক অস্থিতিশীলতায়।
0 মন্তব্যসমূহ