নিউইয়র্ক সিটির প্রথম মুসলিম মেয়র: ইতিহাস গড়লেন জোহরান মামদানি

নিউইয়র্ক, ৫ নভেম্বর ২০২৫: যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো গতকাল। নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন ডেমোক্র্যাটিক সমাজতান্ত্রিক (Democratic Socialist) প্রার্থী জোহরান মামদানি — তিনি এখন শহরের প্রথম মুসলমান এবং দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মেয়র। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে শুধু নিউইয়র্ক নয়, গোটা আমেরিকার প্রগতিশীল রাজনীতিতে এক নতুন বাতাস বইতে শুরু করেছে। বিস্ময়কর এক বিজয় নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হয় মঙ্গলবার রাতে। দীর্ঘ ভোটগণনা শেষে দেখা যায়, জোহরান মামদানি পেয়েছেন মোট ভোটের প্রায় ৫০ শতাংশ, যা তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাক্তন গভর্নর অ্যান্ড্রু কুয়োমো’র ৪১ শতাংশ ভোটের তুলনায় উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে বেশি। রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া পেয়েছেন মাত্র ৭ শতাংশ ভোট। ভোর রাত থেকেই কুইন্স ও ব্রুকলিনে মামদানির সমর্থকদের মধ্যে উল্লাস শুরু হয়। সিটি হলে সামনে মানুষের ঢল নামে — কেউ হাতে পোস্টার, কেউ পতাকা, কেউবা ‘People Over Profit!’ লেখা ব্যানার নিয়ে স্লোগান দেন। এক অভিবাসী পরিবারের গল্প থেকে সিটির শীর্ষে জোহরান মামদানি জন্মগ্রহণ করেন উগান্ডায়, ১৯৯১ সালে। তাঁর বাবা ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা মাহমুদ মামদানি, আর মা লেখিকা মিরিয়াম মামদানি। শৈশবে তিনি নিউইয়র্কে আসেন, পড়াশোনা করেন Bowdoin College-এ, এবং তরুণ বয়সে যুক্ত হন মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের আন্দোলনে। রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ শুরু হয় ২০২০ সালে, যখন তিনি অ্যাস্টোরিয়া (Queens) থেকে নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন। সেখান থেকেই তিনি পরিচিত হন একজন উদারনৈতিক, প্রগতিশীল ও জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে। প্রচারণার মূল অঙ্গীকার: ‘শহর সবার জন্য’ মামদানির পুরো প্রচারণা ঘুরেছে তিনটি মূল অঙ্গীকারকে ঘিরে: 1. সাশ্রয়ী বাসস্থান ও ভাড়ার স্থিতি – শহরের ক্রমবর্ধমান ভাড়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিনি “rent freeze” প্রস্তাব করেন, যাতে সাধারণ মানুষ শহরে টিকে থাকতে পারে। 2. বিনামূল্যে গণপরিবহন – তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস চলাচল হবে ফ্রি, যা নিম্ন আয়ের মানুষ ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর জন্য বিশাল সুবিধা দেবে। 3. শিশুশিক্ষা ও পরিবারবান্ধব নীতি – কর্মজীবী মায়েদের জন্য বিনামূল্যে শিশু যত্নকেন্দ্র এবং উন্নত প্রি-স্কুল ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেন। তাঁর স্লোগান ছিল, “A City That Works for Everyone” — অর্থাৎ এমন একটি নিউইয়র্ক, যা শুধু ধনী বা ক্ষমতাবানদের জন্য নয়, বরং প্রতিটি পরিশ্রমী নাগরিকের জন্য কাজ করবে। জনগণের প্রচারণা, কর্পোরেট নয় মামদানি প্রচারণা শুরু করেছিলেন সাধারণ মানুষের ছোট ছোট দানের মাধ্যমে। তাঁর নির্বাচনী তহবিলের বড় অংশ এসেছে ৫০ ডলারের কম দান থেকে — যা তাকে প্রমাণ করে “grassroots campaigner” হিসেবে। সোশ্যাল মিডিয়া, স্থানীয় ভাষায় প্রচার (আরবি, স্প্যানিশ, বাংলা সহ), ও প্রত্যন্ত কমিউনিটি সেন্টারে সরাসরি যোগাযোগ— এসবই তাঁকে মানুষের কাছে নিয়ে আসে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, “এই প্রচারণা নিউইয়র্কের রাজনীতিতে বার্নি স্যান্ডার্স-ধারার পুনর্জাগরণ।” বিজয়ের পর প্রথম বক্তব্য বিজয় ঘোষণার পর সিটি হলের বাইরে এক আবেগঘন পরিবেশে মামদানি বলেন: “আজ নিউইয়র্ক নতুন ইতিহাস লিখেছে। আমি একজন অভিবাসীর সন্তান, এক মুসলমান, এক প্রগতিশীল স্বপ্নদ্রষ্টা কিন্তু আজ আমি সবার মেয়র। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, এই শহরকে এমন জায়গায় পরিণত করব যেখানে কেউ পিছিয়ে থাকবে না। তিনি আরো বলেন, এই বিজয় কোনো এক ব্যক্তির নয়, এটি সেই ট্যাক্সি চালকের, সেই হাউসকিপারের, সেই শিক্ষার্থীর — যাদের ঘাম ও স্বপ্নে এই শহর গড়ে উঠেছে।” রাজনৈতিক বার্তা ও প্রতীকী গুরুত্ব জোহরান মামদানির বিজয় শুধু একটি প্রশাসনিক পদ অর্জনের গল্প নয় — এটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে একটি শক্তিশালী বার্তা। তিনি প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে ইসলাফোবিয়ার বিরুদ্ধে এক বড় প্রতিরোধের প্রতীক। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশীয়, আফ্রিকান এবং ল্যাটিনো কমিউনিটির ঐক্যের প্রতিফলন। বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, এই বিজয় মার্কিন প্রগতিশীল রাজনীতির ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করছে, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করবে। সামনের পথ ও চ্যালেঞ্জ তবে এই বিজয়ের পরও তাঁর সামনে আছে কঠিন পথ। শহরের বাজেট ঘাটতি, বাড়তে থাকা ভাড়া, অপরাধ ও আইনশৃঙ্খলা, গণপরিবহন ব্যবস্থার ঘাটতি — এসবই বিশাল প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “ভালো উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও, তাঁর অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আইনি ও অর্থনৈতিক বাধা আসতে পারে।” তবুও, মানুষ আশাবাদী — কারণ নিউইয়র্কের ইতিহাসে পরিবর্তনের সব সময়ই সূচনা হয়েছে এমন সাহসী নেতৃত্বের হাত ধরেই। নিউইয়র্কের নতুন অধ্যায় ১ জানুয়ারি ২০২৬-এ জোহরান মামদানি আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেবেন। সেদিন থেকে নিউইয়র্ক সিটি প্রবেশ করবে এক নতুন অধ্যায়ে — একটি শহর, যেখানে একজন মুসলিম তরুণ অভিবাসীর সন্তান সবার প্রতিনিধিত্ব করবেন, যেখানে বৈচিত্র্য হবে শক্তি, আর সহমর্মিতা হবে নেতৃত্বের মূলমন্ত্র।জোহরান মামদানি এখন শুধু নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নন, তিনি হয়ে উঠেছেন এক প্রতীকমূলক চরিত্র — যিনি প্রমাণ করেছেন, আমেরিকার রাজনীতিতে এখনো সম্ভব স্বপ্ন দেখা, সম্ভব ন্যায়ের পথে হাঁটা, আর সবচেয়ে বড় কথা — সম্ভব সাধারণ মানুষের শক্তিতে ইতিহাস লেখা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ