যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়: নিউইয়র্ক স্টেট সুপ্রিম কোর্টে প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিচারপতি সোমা সাঈদ

নিউইয়র্ক | ৬ নভেম্বর ২০২৫, বুধবার রাতে ঘোষিত ফলাফলে ঐতিহাসিক জয় যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে যোগ হলো এক অনন্য অধ্যায়। বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের কন্যা সোমা এস. সাঈদ (Soma S. Syed) নির্বাচিত হয়েছেন নিউইয়র্ক স্টেট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে। তিনি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিচারকই নন, বরং নিউইয়র্কের কুইন্স অঞ্চলের প্রথম মুসলিম নারী বিচারপতি হিসেবেও রেকর্ড গড়েছেন। বুধবার (৫ নভেম্বর) রাতে ঘোষিত নির্বাচনের ফল অনুযায়ী, সোমা সাঈদ দুই লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়ে এই ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেন। এই জয় শুধুমাত্র এক নারীর নয়—এটি অভিবাসী সমাজের, এটি বাংলাদেশি প্রবাসীদের, এবং এটি আমেরিকায় বৈচিত্র্য ও প্রতিনিধিত্বের নতুন এক দৃষ্টান্ত। টাঙ্গাইল থেকে নিউইয়র্ক—এক দীর্ঘ যাত্রা সোমা সাঈদের শিকড় বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায়। তাঁর বাবা আফতাব উদ্দিন সাঈদ ছিলেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট এবং মা ছিলেন একজন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। একজন সরকারি কর্মকর্তা ও শিক্ষিকার ঘরে বেড়ে ওঠা সোমার শৈশব কেটেছে বই, শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের পরিবেশে। মাত্র ১২ বছর বয়সে পরিবারসহ তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। নতুন ভাষা, নতুন সমাজ ও নতুন চ্যালেঞ্জ—সবকিছুর মধ্য দিয়েই শুরু হয় তাঁর আমেরিকান জীবনের গল্প। এই কঠিন অভিযোজনই তাঁকে গড়ে তোলে এক আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ়চেতা নারী হিসেবে। শিক্ষাজীবন ও আইন পেশায় যাত্রা নিউইয়র্ক সিটির পাবলিক স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে সোমা ভর্তি হন City College of New York (CUNY)-এ, যেখানে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন Albany Law School-এ, যেখানে তিনি আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন অন্যরকম—সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ, সমাজের প্রতি সংবেদনশীল, এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অটল। তাঁর সহপাঠীরা তাঁকে স্মরণ করেন এমন একজন হিসেবে, যিনি সবসময় বলতেন— “আইন শুধু রায় দেওয়ার বিষয় নয়, এটি সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। আইনজীবী থেকে বিচারকের আসনে আইন পেশায় প্রবেশের পর থেকেই সোমা সাঈদ কাজ করেছেন মানুষের জন্য, বিশেষত অভিবাসী, নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য। তিনি পারিবারিক আইন, সিভিল মামলা এবং ছোট ব্যবসার বিরোধ নিষ্পত্তিতে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। ২০২১ সালে তিনি নিউইয়র্কের কুইন্স কাউন্টি সিভিল কোর্টের বিচারক হিসেবে নির্বাচিত হন। সেই সময়ই তাঁর নাম উঠে আসে নিউইয়র্কের ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশি-আমেরিকান নারী বিচারক হিসেবে। এবার, ২০২৫ সালের নির্বাচনে তিনি আরও এক ধাপ এগিয়ে নিউইয়র্ক স্টেট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদে নির্বাচিত হয়ে তৈরি করলেন যুক্তরাষ্ট্রে এক নতুন ইতিহাস। বৈচিত্র্য, প্রতিনিধিত্ব ও ন্যায়ের প্রতীক বিচারপতি সোমা সাঈদ তাঁর পেশাজীবনের শুরু থেকেই ছিলেন বৈচিত্র্য ও সমতার পক্ষে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তিনি নিউইয়র্ক সিটি সম-অধিকার প্রয়োগ পরিষদের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ছিলেন Queens County Women’s Bar Association-এর প্রথম দক্ষিণ এশীয় ও মুসলিম নারী সভাপতি। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপেই ছিল সমাজে সমান প্রতিনিধিত্বের দাবি, ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকারের প্রসার, এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতির প্রকাশ। বিজয়ের পর তিনি বলেন এটি আমার ব্যক্তিগত সাফল্য নয়; এটি আমার পরিবার, আমার সমাজ এবং আমার দেশের বিজয়। আমি বিশ্বাস করি, বৈচিত্র্যই শক্তি—এবং এই শক্তিই আমেরিকাকে প্রকৃত অর্থে মহান করেছে। সমাজসেবায় এক অনুপ্রেরণামূলক ভূমিকা বিচারক হওয়ার আগে থেকেই সোমা সাঈদ নিউইয়র্কে সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। কোভিড-১৯ মহামারির সময় তিনি কমিউনিটিতে খাদ্য, মাস্ক ও স্বাস্থ্যসামগ্রী বিতরণে নেতৃত্ব দেন। তাছাড়া অভিবাসী নারীদের আইনি সহায়তা, তরুণ আইন শিক্ষার্থীদের মেন্টরিং, এবং সংখ্যালঘু নারী আইনজীবীদের পেশাগত উন্নয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কমিউনিটির সদস্যরা তাঁকে “প্রেরণার আলো” বলে অভিহিত করেছেন। ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক অনুপ্রেরণা বর্তমানে বিচারপতি সোমা সাঈদ তাঁর স্বামী মিজান চৌধুরীকে নিয়ে নিউইয়র্কের কুইন্সে বসবাস করছেন। তাঁর পরিবারের প্রতিটি সদস্য আজ গর্বিত—কারণ তাঁদের কন্যা এখন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতগুলোর একটিতে ন্যায়বিচারের আসনে বসেছেন। সোমা সাঈদ বলেন— আমার শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে। আমি যেখানেই যাই, সেই মাটির গন্ধ ও মূল্যবোধ আমাকে পথ দেখায়। টাঙ্গাইলের এক মেয়ের স্বপ্ন আজ নিউইয়র্কের আদালতে বাস্তব রূপ নিয়েছে। সোমা সাঈদের এই অর্জন প্রমাণ করেছে—অভিবাসী সমাজের সন্তানরাও কঠোর পরিশ্রম, সততা ও মেধার মাধ্যমে আমেরিকার মূলধারায় স্থান করে নিতে পারে। তিনি শুধু একজন বিচারক নন; তিনি বাংলাদেশের এক গর্বিত মুখ, বৈচিত্র্যের প্রতীক, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম। “ন্যায়বিচার কোনো গোষ্ঠীর সম্পত্তি নয়—এটি মানবতার অধিকার। আর আমি সেই মানবতার পক্ষে। — বিচারপতি সোমা এস. সাঈদ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ